হাড়ের ক্ষয় রোগ একটি নীরব ঘাতক যা মানুষকে আস্তে আস্তে ক্ষতিগ্রস্ত ও পঙ্গু করে এবং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তীব্র ব্যথা, বেঁকে যাওয়া এবং হাড় ভাঙা না হওয়া পর্যন্ত লোক বুঝতে পারে না সে মরণ ব্যাধি হাড়ের ক্ষয় রোগে ভুগছে। প্রাথমিকভাবে কোন সুনির্দিস্ট চিহ্ন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে নীরবে এ রোগ শরীরে থাকে। মানব শরীরে ২০৬ টি হাড় থাকে এবং প্রতিটি হাড় ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম ও অন্যান্য লবন, ভিটামিন, আমিষ এবং কোলাজেন দিয়ে তৈরী হয়। হিসাবে দেখা যায়, ৪০% ব্যক্তির হাড়ের পরিমান বা ঘনত্ব বংশানুক্রমিকভাবে নির্ধারিত হয় এবং ২০% ব্যক্তির হাড়ের পরিমান বা ঘনত্ব নির্ধারিত হয় জীবন ব্যবস্থার মাধ্যমে । ৩০ বৎসর বয়সে হাড়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ থাকে। প্রাকৃতিক নিয়মে ৩০ বৎসরের পর থেকে মানব শরীরে হাড়ের ঘনত্ব ও হাড়ের পরিমান কমতে থাকে। হাড়ের এই হ্রাসের পরিমান নির্ভর করে ব্যক্তির স্বাস্থ্য, খাদ্যাভাস, বংশানুক্রম ও শারীরিক পরিশ্রমের উপর। হাড়ের এই দুর্বল অবস্থা ৫০ থেকে ৬০ বৎসরের মধ্যে সব চেয়ে বেশী হয়। হাড়ের ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য উপাদান ক্ষয়ের ফলে হাড় নরম ও ভঙুর হয় এবং অতিসহজেই ভেঙে যায়। যে কোন হাড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হতে পারে তবে কবজির হাড়, মেরুদন্ডের হাড় এবং কটি’র (হিপ) হাড় সব চেয়ে বেশী আক্রান্ত হয়। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা চারগুন বেশী এবং প্রতি দুই জন মহিলার মধ্যে একজন হাড়ের ক্ষয় রোগে ভুগে, বিশেষ করে যারা শারীরিক গঠনে পাতলা ও খাটো এবং বয়স্ক। প্রায় ২০% মহিলা (ঋতুস্রাব বন্ধের পর) হাড় ক্ষয়ে মেরদন্ডের কশেরুকা ভাঙায় ভুগে এবং পরবর্তী বৎসরে সাধারনত আরেকটি নতুন হাড় ভাঙে। এসিয়া মহাদেশের মহিলারা (বিশ্বের ৫০ শতাংশ) ও যাদের পরিবারের অন্যান্যরা এ রোগে ভুগছে এবং তাড়াতাড়ি বা অপারেশনের মাধ্যমে ঋতুস্রাব বন্ধ হয়েছে এমন মহিলারা হাড়ের ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয় বেশী। এন্ডোক্রাইন (গ্রন্থি) সমস্যা, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, যক্ষ্মা, ড্রাগ (স্টেরয়েড, এন্টিকনভ্যালসেন্ট, হেপারিন), খাদ্য নালীর অপারেশন ও খাদ্য নালীর রোগ (সিলিয়াক ডিজিজ) এবং লিভারের (যকৃত) সমস্যা হাড়ের ক্ষয় করে। এ ছাড়াও শারীরিক পরিশ্রম কম করলে, ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার কম খেলে এবং ধুম ও মদ্য পান করলে হাড়ের ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
উপসর্গ :
প্রথমে পিঠে, কোমড়ে, ঘাড়ে ও পেশীতে অল্প ব্যথা হয় এবং পরবর্তীতে হঠাৎ করে তীক্ষ্ম ব্যথা হয়। এই ধরনের ব্যথা এক সপ্তাহ থেকে তিন মাস পর্যন্ত বিদ্যমান হতে পারে। মেরুদন্ডের কশেরুকার উচ্চতা কমে যায়, রোগী সামনে ঝূকে থাকে এবং পিছনে কুঁজ হয়। একে কাইফোটিক আকৃতি বলে। কশেরুকা ভাঙার ব্যথা মেরুদন্ড হতে শুরু হয়ে পিঠের দুই পার্শ্বে দিয়ে সামনের দিকে আসে এবং বুক ও পেটে অনুভূত হয় এবং পা পর্যন্ত যায়। সাধারনত পড়ে গিয়ে হালকা আঘাতেই ক্ষয়জনিত কারণে কটি ও কবজির হাড় ভেঙে যায়। কটির (হিপ জয়েন্ট) হাড় ভাঙা রোগীর ২০% পরবর্তী বৎসর মারা যায়। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ রোগী সুস্থ হয়ে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় যেতে পারে।
প্রতিকার :
উপযুক্ত ব্যায়াম যেমন নিয়মিত হাটা, জগিং, সিঁড়ি দিয়ে উঠা-নামা করা এবং ওজন বহন করা ইত্যাদি করলে হাড় ক্ষয় কম হবে। কিশোর বয়সে কায়িক পরিশ্রম করলে হাড়ের পরিমান বেড়ে যায় এবং হাড় মোটা হয়। ফলে বৃদ্ধ বয়সে হাড় ক্ষয় কম হয়। সুষম খাদ্য এবং কিশোর বয়সে ১৩০০ মিলি গ্রাম, ৫০ বৎসর পর্যন্ত ১০০০ মিলি গ্রাম এবং ৫০ বৎসরের উর্ধ্বে ১২০০ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম দৈনিক সেবন করা উচিত। ধুমপান ও মদপান থেকে বিরত থাকা। পড়ে যাওয়া বা দুর্ঘটনা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। হাড়ের পরিমান হ্রাস, দুর্বল ও ভঙুরতা প্রতিরোধে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং ওষুধ সেবন।
চিকিৎসা :
চিকিৎসা নির্ভর করে হাড়ের পরিমান হ্রাস, হাড়ের দুর্বলতা, ভঙুরতা ও হাড়ের ভাঙার উপর। নিয়মিত নির্দেশিত ব্যায়াম করতে হবে। দৈনিক পরিমিত ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, ডি এবং মিনারেলস সেবন করা। বিসফোসফোনেট জাতীয় ওষুধ (যেমন, এলেনড্রোনেট, ইটিড্রোনেট ও রাইসড্রোনেট) চিকিৎসকের পরামর্শ মতে সেবন করতে হবে। প্রয়োজনে হোরমোন ও ক্যালসিটোনিন ইনজেকশন পুশ করতে হবে। ব্যথা নিরাময়ের জন্য এনালজেসিক ওষুধ ও ফিজিকেল থেরাপি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। হাড় ভাঙার জন্য কনজারভেটিভ বা সার্জিকেল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
লেখক: ডা: জি. এম. জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিক সার্জারী বিভাগ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন প্রতিষ্ঠান(নিটোর), ঢাকা
[প্রিয় পাঠক, আপনি যদি হেলথকেয়ার প্রফেশনাল হন তাহলে স্বাস্থ্যসেবা.কম এ লিখতে পারেন। রোগ লক্ষন ও প্রতিকার, ওষুধ, খাবারের গুনাগুন ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লাইফস্টাইল নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছবিসহ ই-মেইল করুন- write@shasthoseba.com -এ ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।]